সন্ধ্যা ৭:১৮,   বুধবার,   ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,   ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,   ৯ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

আশ্রয় কেন্দ্রে যাদের ঈদ কাটবে

নোহান আরেফিন নেওয়াজ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ :
রাত পোহালেই পবিত্র ঈদুল আযহা। মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। তবে চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আর বন্যার কারণে বৃহৎ এ উৎসবে সামিল হতে পারছে না দক্ষিণ সুনামগঞ্জের নিন্ম ও মধ্যবিত্ত-পরিবারগুলো। একদিকে করোনাভাইরাস, অন্যদিকে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া তিন দফা বন্যার ক্ষত মিলিয়ে মানুষ বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত।
অথচ অন্যান্য বছর কোরবানির ঈদ এলেই হাট-বাজারে মশলা কেনা-বেচা আর পশু নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটতো হাওরাঞ্চলবাসীর। দা, চুরি শান দিয়ে রাখা থেকে শুরু করে নতুন পোশাক ক্রয়ের প্রতিযোগিতা। সবই ছিল, কিন্তু এবার কোথাও আনন্দ কিংবা উৎসবের আবহ নেই। আছে বিষাদের সুর, ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প; ঠিকে থাকার যুদ্ধ।
কারণ হাওর এলাকার বেশকিছু এলাকার বাসিন্দারা এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন। আর যারা বানের পানি কমার সাথে সাথে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে গেছেন। তারাও যুদ্ধ করছেন ভিটেমাটি টিকিয়ে রাখার। বানের জলে ক্ষত-বিক্ষত ভিটেমাটিতে আবার সাজিয়ে তোলার।
তবে বন্যার ক্ষত আর করোনা-ভীতি কাটিয়ে মানুষ কিছুটা দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন উপজেলার নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। মাসব্যাপী বানের পানিতে বন্দি থাকায় আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। কাজকর্ম করতে না পারায় ধারদেনা করে পরিবারে যোগান দিয়েছেন কেউ কেউ।
এসব কারণে অধিকাংশ বানভাসিদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বানভাসি অনেকেই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এমন সংকট অবস্থায় ঈদ উৎযাপন তাদের কাছে বড্ড বেমানান। বানভাসি এসব পরিবারে ঈদ আনন্দ উৎযাপনের পরিবর্তে চলছে বাঁচার লড়াই।
পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের চন্দ্রপুর গ্রামের শফিক আলী বলেন, করোনার কারণে এমনিতেই খেয়ে না খেয়ে থাকতাম। এর মধ্যে একটানা তিনবার বন্যায় আমি একেবারে বিপর্যস্ত। পরিবারের ৭ জন সদস্য নিয়ে ছোট এক ঘরে থাকতাম। বন্যায় আমার ঘর ভেঙ্গে নড়বড়ে হয়ে গেছে। পরিবারের খাদ্য-জোগান দিতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছি। এমন অবস্থায় ঘর মেরামত কিভাবে করবো সেই চিন্তায় ঘুম হয় না। এমন অবস্থায় সরকারী পুনর্বাসন সহযোগিতা চান তিনি।
পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া আয়শা বেগম ও কাছম আলীর স্ত্রীর অভিযোগ বন্যার একমাস পেরিয়ে গেলে ও সরকারী ত্রাণ জুটেনি তাদের ভাগ্যে। এদিকে আয় রোজগার না থাকায় মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন তারা। ফলে শিশু সদস্যদের নতুন জামা কিনে দিতে না পারায় কষ্টের সীমা নেই আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত এই বানভাসিদের।
এদিকে বন্যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যেও। প্রতিবছরই ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে এমন সময় বেচাকেনার ধুম পড়ে উপজেলার হাঁট-বাজারে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ভিড় থাকতো বিপণীগুলোতে। সন্দেশ-পিঠা ও মসলার খরচ করতে ও ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকতো ভেরাইটিজ ষ্টোরগুলোতে। তবে এবছর বেচাকেনা খুবই কম হওয়ায় হতাশ ব্যবসায়ীরাও। মোটা অঙ্কের টাকার পণ্য দোকানে আমদানি করলেও ক্রেতা কম হওয়ায় পণ্য বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। ফলে মারাত্মক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
হাই চয়েজের সত্ত্বাধিকারী আক্তার আহমেদ জানান, ঈদ উপলক্ষে বাড়তি টাকা ধার-দেনা করে পণ্য তুলেছি। কিন্তু আশানুরূপ বেচাকেনা হয়নি। তাই ধারের টাকা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছি। ব্যবসার এমন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে টানা তিন দফা বন্যা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন তিনি।
এরই মধ্যে এক মাসের অধিক সময় স্থায়ী হওয়া এবারের বন্যাকে ২০০৪ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনা করছেন কেউ কেউ। ফলে এবার মানুষের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন দিতে এবং দুর্গত অঞ্চলে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি মাঠ-পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি ডা. শাকিল মুরাদ আফজাল বলেন, এবছরের বন্যার স্থায়িত্ব বেশি হওয়ায় আমাদের উপজেলার মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০০৪ সালের পর বন্যায় এতো ক্ষয়ক্ষতি বিগত কোনো বছরে হয়নি। কাজেই বিপদগ্রস্ত মানুষদের সরকারি ত্রাণসামগ্রীর পাশাপাশি বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন দিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এ ব্যাপারে উপজেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া জানান, বন্যা-কবলিতদের মাঝে উপজেলায় ৬৬ মেট্রিক টন চাল ও নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের কোনো বরাদ্দ উপজেলায় এখনও আসেনি। যদি বরাদ্দ আসে তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে তা বণ্টন করে দেওয়া হবে।