হাওরাঞ্চলে নানা সীমাবদ্ধতায় ব্যাহত অনলাইনে পাঠদান
আবির হাসান মানিক, তাহিরপুর :
একে তো কয়েক দফায় বন্যা, তার উপর করোনা পরিস্থিতি। এর মাঝে কর্মহীন নিম্নআয়ের মানুষের আহাজারি সব মিলিয়ে হাওরবাসী যেন কিছুতেই স্বস্তি ফিরে পাচ্ছে না। এর সাথে নিম্নবিত্ত পরিবারে নতুন করে যোগ হয়েছে করোনাকালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় এসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে সম্পৃক্ত করতে না পারার হতাশা আর মনোকষ্ট।
করোনাকালীন সময়ে সারাদেশের ন্যায় হাওরাঞ্চল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বন্ধ হয়ে পড়ে নিয়মিত পাঠদান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার চালু করে টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম। তবে টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রমে শহরাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত হতে পারলেও নানামুখী প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা থাকায় এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে পাঠদান থেকে বঞ্চিত হাওর পরিবেষ্টিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শিক্ষার্থীরা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হাওরাঞ্চলের নিম্নআয়ের লোকজন জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে শিক্ষার্থীকে টেলিভিশন, স্মার্ট মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ডাটা প্যাক বা কম্পিউটার কিনে দিবে অনলাইন ক্লাসে সম্পৃক্ত করার জন্য, এ যেন অলিক চিন্তা!
এদিকে নিম্নআয়ের এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইন বা টেলিভিশন মাধ্যমে ক্লাসে অংশ নিতে না পারার হতাশা আর মনোকষ্ট। আর স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা হাওরাঞ্চলে অনলাইনে ক্লাস ফলপ্রসূ করতে হলে মোবাইল অপারেটিং নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণসহ বিশেষ আর্থিক সহযোগিতার দাবি তুলেছেন।
সীমান্তবর্তী স্কুল বীরেন্দ্রনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফাহিম আহমেদ এর অভিভাবক মো. কালাম এ প্রতিবেদককে বলেন, শুনছি সরকার ইন্টারনেটে ক্লাস চালু করেছে। কিন্তু এতো ছোট বয়সের ছেলের হাতে স্মার্ট মোবাইল দিতে আমি আগ্রহী না, তাছাড়া অনলাইন, ইন্টারনেট বিষয়টিও আমি বুঝি না।
এদিকে বাদাঘাট উত্তর ইউনিয়নের মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাদিয়া আকতার জানান, ‘ম্যাডাম একদিন বলেছিলেন স্মার্ট মোবাইল কেনার জন্য, কিন্তু মোবাইল আর কেনা হয়নি। ইন্টারনেটে কিভাবে ক্লাস করে তাও কোনদিন দেখিনি।’
আর তাহিরপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এর নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী কমা তালুকদার জানান, স্কুলে ক্লাস বন্ধ হয়ে যাবার পর শুনেছি ইন্টারনেট, ফেসবুকে ক্লাস চালু করেছে। অনলাইনে ক্লাস করতে আমারও অনেক আগ্রহ ছিল, কিন্তু স্মার্ট মোবাইল ফোন কেনার মতো আমার পরিবারের সামর্থ্য না থাকায় তা আর করতে পারিনি।’
এ প্রসঙ্গে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল বড়দল উত্তর ইউনিয়নের চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মনিরা আজিম বলেন, এ অঞ্চলে অনেক আদিবাসী শিক্ষার্থী রয়েছে। এন্ড্রয়েড মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে অনেক পরিবারেরই ইন্টারনেটে ক্লাস করবে সে রকম মতো সামর্থ্য নেই। নেই টেলিভিশনও। আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে অডিও ফোনে কথা বলেছি, পরামর্শ দিয়েছি, কিন্তু এন্ড্রয়েড মোবাইল ও টেলিভিশন না থাকার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. সানজু মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘হাওরাঞ্চলে অধিকাংশ পরিবার ইন্টারনেট, অনলাইন এসব সম্পর্কে ততটা জানে না, তাছাড়া ইন্টারনেটনির্ভর এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনবে সেরকম সক্ষমতাও এসব পরিবারের নেই। আমরা শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু নানান প্রতিবন্ধকতা থাকায় সরকারের এ উদ্যোগ হাওরাঞ্চলে ফলপ্রসূ হয়নি।’
এদিকে জাদুকাটা নদী তীরবর্তী সোহালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম সরোয়ার লিটন বলেন, অনলাইনে পাঠদান একটি চমৎকার উদ্যোগ। তবে তা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিকল্প নয়। করোনাকালীন এই উদ্যোগ সময়োপযোগী হলেও হাওরাঞ্চলে শিক্ষার্থীদের অনেকেই এ পাঠ গ্রহণে বঞ্চিত হচ্ছে। অভিভাবকদের শিক্ষা ও প্রযুক্তি জ্ঞান কম থাকা এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার বিরুপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের উপর। তবে শিক্ষকগণ চেষ্টা করছেন। ইউনিয়ন পরিষদগুলো এগিয়ে আসলে তা আরো কার্যকরী হতো।
এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যম কর্মী বাবরুল হাসান বাবলু জানান, হাওরে কোন প্রকার প্রভাব পড়েনি অনলাইন শিক্ষার। অনলাইন কি এটাই জানে না অধিকাংশ হতদরিদ্র পরিবার! ডিজিটাল পাঠদানের জন্য দুটো জিনিস প্রয়োজন একটি টিভি অন্যটি স্মার্ট ফোন। হাওর পারে অধিকাংশ বাড়িতে এ দুটোর কোনটাই নেই, তাই মনে করি এ শিক্ষার কোনই প্রভাব পড়েনি হাওরাঞ্চলে।
আর আবুল হোসেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজকর্মী মো. আবুল হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থার যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারের অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা আমাদের হাওরাঞ্চল তাহিরপুরে ফলপ্রসূ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
একে তো করোনার করুণ থাবা, অন্যদিকে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধানতম কর্মক্ষেত্র যাদুকাটা নদী ও তিনটি শুল্কস্টেশন বন্ধ থাকায় উপার্জনহীন শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির বাজারে সন্তানদের সাধারণ শিক্ষায় যেখানে সম্ভব হয়ে উঠেনা, সেখান অনলাইনভিত্তিক ক্লাস তাদের কাছে বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের আর্থিক অসচ্ছলতা ও প্রযুক্তির সুবিধা না পাওয়ায় হাওরের শিক্ষার্থীরা এসব উদ্যোগ থেকে তেমন সুবিধা পায়নি। তুলনামূলকভাবে শহরের শিক্ষার্থীরা বেশি সুবিধা পেয়েছে। এতে আরও বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন- ‘অতিসত্বর হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থ্রিজি, ফোরজি ইন্টারনেট সুবিধা বাড়াতে হবে। একই সাথে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ আর্থিক সহযোগিতার দাবি জানাই।’