রাত ৩:৩১,   শনিবার,   ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,   ১২ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,   ২৪শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

সুনামগ‌ঞ্জের যে হাসপাতালের সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি

ডেস্ক নিউজ :
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সেলিমগঞ্জ বাজারে একটি দ্বিতল ভবন। ভবনের গায়ে লেখা রয়েছে – ‘সোনার বাংলা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। নামেই যে কারো দৃষ্টি কাড়বে এই স্থাপনাটি। তবে এরচেয়েও বড় তথ্য এই হাসপাতালের সাথে জড়িয়ে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি। হাসপাতালটির জন্য ‘সোনার বাংলা’ নামও পছন্দ করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে এখানে একজন চিকিৎসকসহ ৫জন স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়।
সম্প্রতি এই হাসপাতালটির পুরনো ভবনের বদলে বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটি চিকিৎসকশূন্য অবস্থায় আছে। একজন কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার থাকলেও তিনি সপ্তাহে একদিন হাসপাতালে বসেন। পফলে চিকিৎসার বঞ্চিত হচ্ছেন হাওরপাড়ের বাসিন্দারা।
এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা নিয়ে দু’ধরণের তথ্য পাওয়া গেছে। একপক্ষের দাবি, ’৭০ এর নির্বাচনের আগে জনসংযোগে হাওর এলাকায় যান শেখ মুজিবুর রহমান। এসময় হাওর এলাকায় টানা সাতদিন অবস্থান করেন তিনি। জনসংযোগকালে জামালগঞ্জেহর সাচনাবাজারে জনসভা এবং সেলিমগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পথসভা করেন।
ওই সময়ে হাওর এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুযোগই ছিলো না। একমাত্র হাসপাতাল ছিলো জেলা সদরে। দুর্গম হাওর এলাকা থেকে ওই হাসপাতালে আসতে লেগে যেতো এক থেকে দেড়দিন। ফলে চিকিৎসব বঞ্চিত থাকতে হতো হাওরপাড়ের মানুষদের। বঙ্গবন্ধু হাওরবাসীর এই দুর্দদার চিত্র উপলব্দি করেন। সেলিমগঞ্জ বাজারে অনুষ্ঠিত পথসভায় স্থানীয় বাসিন্দারাও বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি নির্বাচিত হলে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। এতে রাজী হন বঙ্গবন্ধু। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সেলিমগঞ্জে ‘সোনার বাংলা দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করেন বঙ্গবন্ধু।
‘৭০-এ যখন বঙ্গবন্ধু হাওর এলাকা চষে বেড়ান তখন তার সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিলেন জামালগঞ্জের গোলকপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাল মিয়া।
তিনি বলেন, সেলিমগঞ্জ বাজারে পথসভা শেষে ওই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা সাবির উদ্দিন সরকার এলাকার একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে নির্বাচিত হলে হাসপাতাল নির্মাণ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফেরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এই হাসপাতালটি নির্মাণ করে দেন। সাবির উদ্দিন সরকারই হাসপাতালের জন্য জমি দান করেন। প্রথমে এর নাম ছিলো ‘সোনার বাংলা দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র’।
এলাকার আরও কয়েকজন প্রবীন ব্যক্তিও এমন তথ্য জানিয়েছেন।
তবে কিছুটা ভিন্ন তথ্য জানিয়েছেন সাবির উদ্দিন সরকারের ছেলে জামালগঞ্জের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও আইনজীবী আসাদউল্লাহ সরকার।
তিনি বলেন, যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে দেখি শরনার্থী শিবির থেকে অনেকে নানা ধরণের অসুখ নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউই চিকিৎসা পাচ্ছে না। তখন আমার বাবা-মার কাছ থেকে দুইশ’ টাকা নিয়ে ওষুধপত্র কিনে অসুস্থদের মধ্যে বিতরণ শুরু করি। এরপর আরও অনেকের সহযোগিতায় আমাদের জায়গায় দাতব্য চিকিৎসালয়ের কার্যক্রম শুরু করি।
তিনি বলেন, এরপর আমি ’৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি। সাক্ষাতকালে হাসপাতালের বিষয়টি তাকে জানাই। এবং হাসপাতালের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু দাতব্য চিকিৎসালয়’ এবং ‘সোনার বাংলা দাতব্য চিকিৎসালয়’ দুটি নাম প্রস্তাব করে তাকে একটি পছন্দ করে দিতে বলি। তিনি ‘সোনার বাংলা’ নামটি পছন্দ করেন। এরপর তার তৎকালীন ব্যক্তিগত সহকারি তোফায়েল আহমদের সাথে কথা বলতে বলেন। তোফায়েল আহমদ কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে। এর মাসখানেক পর এই হাসপাতালের নামে রেডক্রসের পাঠানো চিকিৎসাসামগ্রী ও ওষুধ সহায়তা আসে।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে এই হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসক, নার্সসহ ৫জন স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়।
হাসপাতালটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোনার বাংলা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আগের ভবনটি জরাজীর্ন হয়ে পড়ায় নতুন দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে নতুন এই ভবনের উদ্বোধন করা হয়। তবে তার আগে থেকেই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেই কোনো চিকিৎসক, নার্স। একজন পিয়ন ছাড়া আর কোনো স্থায়ী স্টাফই নেই এখানে। সুনামগঞ্জ থেকে একজন কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সপ্তাহে একদিন এসে রোগী দেন। সপ্তাহের বাকী ছয়দিন প্রায় বন্ধই থাকে হাসপাতালটি। পাওয়া যায় না কোনো ওষুধপত্রও।
এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যাপারে জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলমগীর হোসেন বলেন, আমি গতবছর এখানে এসেছি। তার আগে থেকেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। সঙ্কটের কারণে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে শীঘ্রই যাতে এই হাসপাতালে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া যায় এ ব্যাপারে চেষ্টা চলছে।