সকাল ৯:৪১,   শনিবার,   ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,   ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,   ২০শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

হাওরে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনের ‘মহোৎসব’

আবির হাসান মানিক :
বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি এবং রামসার স্থান টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওয়ের মাছ দিয়েই দেশের অধিকাংশ মিঠাপানির মাছের চাহিদা পুরন হয়। কিন্তু এবছর টাঙ্গুয়ার হাওরসহ তাহিরপুরের ছোট-বড় বিভিন্ন হাওরে অবলীলায় চলছে পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ নিধনের মহোৎসব। আইন অনুযায়ী ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এটাকে অপরাধ হিসাবেই মনে করেন না এ অঞ্চলের জেলে ও কৃষকরা! তাই অবলীলায় এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেই কোন পদক্ষেপ।
মূলত হাওরাঞ্চলের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মধ্যে নতুন ধানের গরম ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ দিয়ে রান্না করে টাকি ও শোল মাছের পোনা খাওয়ার রীতি বেশ পুরনো। একটা সময় তা সীমিত আকারে থাকলেও দিন দিন বেড়ে চলেছে ডিমওয়ালা ও পোনামাছ ধরার প্রবণতা। আর পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনের ফলে কেবল মাছ-ই নির্বংশ হচ্ছেনা, ধ্বংস হচ্ছে হাওরের জলজ অস্তিত্বও।
মাছের অভয়াশ্রম এসব হাওরে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন বন্ধ না করলে দেশীয় মৎস্য সম্পদ বিলুপ্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন হাওরবাসী। দেশীয় মৎস্য সম্পদ নিধনযজ্ঞ রোধে প্রশাসনের জোর তৎপরতা বাড়ানোর দাবিও জানিয়েছেন তারা।
মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, চাষের উদ্দেশ্য ব্যতীত প্রতি বছর ১ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট ( চৈত্র মাসের মাঝামাঝি হতে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি) পর্যন্ত শোল, গজার, টাকি মাছের পোনা ঝাঁক বা দম্পতি মাছ ধরা ও ধ্বংস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। কেউ এ আইন অমান্য করলে অর্থদণ্ড ও জেল কিংবা উভয় দণ্ড হতে পারে। কিন্তু তাহিরপুরে এসব আইন লেখায় থাকলেও বাস্তবে নেই কোন প্রয়োগ।
উপজেলার ছোটবড় ২৩টি হাওরেরই বর্তমানে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শেষ। তাই শ্রমজীবী অনেকেই সকাল বেলা ঠেলা জাল নিয়ে বিভিন্ন হাওরে মাছের পোনা ধরতে বের হয়। তাছাড়া এ সময়টাতে জেলেরাও হাওরে বিভিন্ন ধরণের জাল দিয়ে মাছ ধরে। ঠেলা জালে কাচকি, শোল, টাকি, কই, গজার, ঘনিয়া মাছের পোনা ধরা পড়ে। তবে পোনার মায়ার কারণে এ সময় দম্পতি মাছও ধরা পড়ে।
উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা টাঙ্গুয়ার হাওর কেন্দ্রীয় সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য অখিল তালুকদার জানান, রামসার সাইট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল অভয়াশ্রম লেউচ্চামারা, রুপাবই, হাতিরগাতা, তেঘুনিয়া, বেরবেরিয়া ও রৌয়াতে চলছে ডিমওয়ালা মা মাছ নিধনযজ্ঞ। নিমকরে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক জেলে টাঙ্গুয়ার হাওরে ডিমওয়ালা মা মাছ ও পোনা মাছ ধরে। এমনিতেই হাওরে কমছে দেশীয় মাছের সংখ্যা। আর এভাবে যদি চলতে থাকে তবে হাওরের রুই বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবেনা।
হাওরপাড়ের বাসিন্দারা জানান, হাওর যদি পানিতে একদিনে ডুবে যায় তবে পোনা মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ কম ধরা পড়ে। যদি ধীরে ধীরে পানিতে ডুবে তবে পোনাসহ সবধরনের মাছ ব্যাপকভাবে ধরা পড়ে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কোন হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করেনি। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ঢুকলে স্রোত তৈরি হবে। আর এতেই রুই, ঘনিয়াসহ বিভিন্ন মাছ ডিম ছাড়বে। কারণ পানির স্রোত না থাকলে এসকল মাছ ডিম ছাড়তে পারেনা।
টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের শিক্ষক সাঞ্জু মিয়া বলেন, যদি আমরা মৎস্য সংরক্ষণ আইন মেনে মাছ ধরি তবে হাওরবাসীর মাছের চাহিদা পূরণ হবে নিঃসন্দেহে পাশাপাশি জেলেরাও বৈধ উপায়ে মাছ ধরে প্রচুর অর্থ আয় করতে পারবে।
হাওর বাঁচাও সংগঠনের উপজেলা যুগ্ম আহবায়ক ফেরদৌস আলম বলেন, একটা সময় ছিল যখন জেলে ও কৃষকেরা স্বল্প আকারে পোনা মাছ শখের বসে ধরত। এ সময় দম্পতি মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ ধরা নিষেধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে যেন সব ধরনের মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। দেশীয় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় এটা বন্ধ হওয়া জরুরি। যদি প্রতি বছর আইন মেনে হাওরে মাছ ধরা হয় তবে মিঠা পানির মাছের কোন অভাব পড়বেননা হাওরবাসীর।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, প্রতি বছর হাওরে প্রথম যখন পানি প্রবেশ করে সবাই সদলবলে মহাসমারোহে মাছ ধরতে যায়। একে স্থানীয় ভাষায় উইয্যা বলে। অথচ এই সময়টা মাছের প্রজনন কালীন সময়। গতকাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে উইয্যা মারা শুরু হয়েছে। অবাধে চলছে মা মাছ ও পোনা নিধন। এটি বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ চাই।
তাহিরপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সারওয়ার আলম বলেন, হাওরে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এসব কাজ প্রতিহত করতে জেল, অর্থদণ্ড করা হয়।