রাত ১১:৫১,   শুক্রবার,   ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,   ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,   ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বদলে যাচ্ছে হাওরের অর্থনীতি

বিশেষ প্রতিনিধি
ধান, মাছ সবজি ফলনে চাঙ্গা হচ্ছে হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের অর্থনীতি। চলতি বছর এই জেলা থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ধান, সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার মাছ ও ১৩শ কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হয়েছে। প্রতি বছর লক্ষমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় হাওরে এখন অভাব দূর হয়ে সচ্ছলতা ফিরেছে কৃষকদের।

জানা যায়, সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় ১৩৭টি ছোট বড় হাওর নিয়ে গড়ে উঠেছে ভাটি এলাকা। দেশের অন্য যে কোন এলাকা থেকে এটা সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রম। এখানকার জীবনযাত্রা,সংস্কৃতি, ভাষা,ভূ-প্রকৃতি কিংবা জলবায়ু সব কিছুই ব্যতিক্রম। বছরের প্রায় ৬ মাস গোটা হাওর এলাকা থাকে পানিতে নিমগ্ন। আর ৬ মাস শুকনা। যার ফলে এখানকার অর্থনীতি ঘরে উঠেছে প্রকৃতির সাথেই তাল মিলিয়ে।


প্রায় ৩ হাজার ৭শ ৪৭ বর্গ কিলোমিটার হাওর এলাকার ৮০ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। এখানকার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনকে ঘিরেই ঘরে উঠেছে মানুষের জীবনমান। শুকনা মৌসুমে হাওরের ধান, সবজি সহ সকল ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন করা হয় আর ভরসা মৌসুমে যখন হাওরের এলাকা পানিতে টইটুম্বুর থাকে তখন মাছ আহরণ ও উৎপাদন করেই এখাকার মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। ফলে এই দুই পেশাকে ঘিরেই যেমন এখানকার মানুষের জীবন মান পরিবর্তন হয়েছে তেমনি আধুনিকতার পরশে জীবন মানের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে হাওরের এলাকার অর্থনীতি।
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরের কৃষক আব্দুল মতিন। এক সময়
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধানের চারা রোপন থেকে ধান মাড়াই পর্যন্ত প্রাণান্তক পরিশ্রম করতে হতো। খরচও হতো বেশি। বর্তমানে কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোয়া। এখন মাঠে মাঠে ট্রাক্টর ও সেচ্ছপাম্প। যোগ হয়েছে ধানের চারা রোপন, ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্র। এতে কমেছে কঠোর পরিশ্রম, সময় ও খরচ। বেড়েছে কাঙ্খিত ফসলের উৎপাদন।
কৃষক মতিন মিয়া নিউজসুনামগঞ্জ.কমকে বলেন, ধান উৎপাদন করে সাফ্যলের মুখ দেখতে পাচ্ছি। আগে ধান উৎপাদন করে তেমন লাভ হত না এখন ধান উৎপাদন করে অনেক লাভবান হাওরের কৃষকরা।

গত বছর সুনামগঞ্জে ১৩ লক্ষ ৮ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধানের উৎপাদন হয় যা থেকে চাল উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৭২ হাজার ১শ ৪৯ মেট্রিক টন যার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৬শ কোটি টাকা।
তবে চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ১৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। যা থেকে ৯ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য ৩হাজার ৮শ কোটি টাকা।


পাশাপাশি গত বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ৯৮ হাজার৫শ মেট্রিক আমন ধানের উৎপাদন হয় যেখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে১ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্যে ছিল ৮ শ কোটি টাকা।
তবে চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ৩ লাখ ১০ হাজার আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে। যেখান থেকে ২ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক চাল উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্যে ৮ শ ৩০ কোটি।
কৃষকরা বলছেন, ধান চাষ করে বর্তমানে হাওরে কৃষকরা অর্থনেতিক দিক দিয়ে অনেক লাভবান হচ্ছেন।

এদিকে, হাওর অধ্যুষিত জেলা হওয়ায় সুনামগঞ্জে দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়ছে। এই জেলা প্রায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ২০টি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৫৩টি। বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। এছাড়াও জেলায় ছোটবড় প্রায় এক হাজার বিল রয়েছে। যা থেকে ২০০ প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয় এবং সেই মাছ সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে ১৬০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়।


গত বছর এই ভাটির জেলা থেকে ১ লক্ষ ৭ হাজার ৫শ ৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা হয় যার বাজারমূল্য ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত ১৬ জুনের ভয়াবহ বন্যায় সুনামগঞ্জের সকল মাছ ভেসে যায়। ফলে নিশ্বস হয়ে পড়েন জেলার ১৭ হাজার
মাছ চাষীরা। তারপরও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুধে টাকা নিয়ে চলতি বছর আবারও মাছ চাষ করেছেন চাষীরা। যেখান থেকে ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫শ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে যার বাজারমূল্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
তবে মাছ চাষীরা বলেন, বর্তমানে মাছ চাষ করে তারা অনেক লাভবান। তবে যে বছর বন্যা হয় সে বছর তাদের লোকশান গুণতে হয়।

মাছ চাষী হেলাল মিয়া নিউজসুনামগঞ্জ.কমকে বলেন, প্রতিবছর বন্যায় মাছ চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের কাছ থেকে কোন সহযোগীতা পাইনা। তবে মাছ চাষ করে আমরা অনেক লাভবান। যে বছর বন্যা হয় সেই বছর আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।


সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম নিউজসুনামগঞ্জ.কমকে বলেন, সুনামগঞ্জ হাওর এলাকা হওয়ায় এখানে দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়ছে। তবে মাছ,চাষীরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের আর্থিক সহযোগিতা এমনকি এই জেলায় আরোও মাছ উৎপাদন বাড়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এদিকে ধান ও মাছের পর এই জেলার উত্তর পাড়ে ব্যাপক সবজির উৎপাদন বেড়েই চলেছে। সেই সবজি সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের সবজি চাষী সজিব মিয়া। এই বছর ২০ একর জমির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করেছেন সেই সবজির বাম্পার ফলনে জীবন বদলে গেছে তার। ইতিমধ্যে তিনি ২০ লাখ টাকার সবজি বাজারে বিক্রি করেছেন।
সবজি চাষী সজিব নিউজসুনামগঞ্জ.কমকে বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এই বছর সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। এবং বাজারে অনেক দাম পেয়েছি।
শুধু সজিব মিয়া নয়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি বছর সুনামগঞ্জে সবজির বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় হাসি ফুটেছে চাষীদের মুখে। সেই সাথে এই সব সবজি সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করা হচ্ছে।

গত বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের সবজির উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য ৯শ ৫০ কোটি। তবে চলতি বছর সুনামগঞ্জে ৩ লাখ মেট্রিক টন সবজির উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্যে ১৩শ কোটি টাকা। ফলে দিন দিন এই ভাটির জেলায় সবজি উৎপাদন বাড়ছে।

সবজি চাষীরা বলেন, সুনামগঞ্জে প্রতি বছর সবজি উৎপাদন বেড়েই চলেছে। তবে কৃষি বিভাগ যদি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সহযোগীতা করে তাহলে এই জেলায় আরোও সবজি উৎপাদন বাড়বে।
সুনামগঞ্জ কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম নিউজসুনামগঞ্জ.কমকে বলেন, হাওরের দিন দিন ধান ও সবজির উৎপাদন বাড়ছে। এতে কৃষকরা অনেক লাভবান হচ্ছে এবং হাওরের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী নিউজসুনামগঞ্জ.কমকে বলেন, সুনামগঞ্জের অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যেহুতু এটি হাওর প্রধান এলাকা সেই জন্য হাওরের ধান,মাছ সবজি উৎপাদন বাড়তে আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সহযোগীতা করে যাচ্ছি।