দুপুর ১২:২৩,   রবিবার,   ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,   ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,   ১৯শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

করোনা আতঙ্কে ভিন্ন এক বৈশাখ : মশিউর রহমান

আজ পহেলা বৈশাখ। ১৪২৭ বাংলা। বাঙ্গালী উৎসব প্রিয় জাতি। সেই চিরাচরিত বৈশাখি উৎসব আজ নেই। ঘরে ঘরে মানুষ বন্ধী। লোকজন একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে বের হচ্ছে না। পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে গৃহবন্ধী থাকতে। দেশের দেড় কোটি খেটে খাওয়া মানুষ যারা দিনে আনে দিনে খায় তারা ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির। বৈশ্বিক আতঙ্ক মরণব্যাধী করোনা নামক এই ভাইরাসের ভয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষ দিক বিদিক ছুটছে। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক নগরী নিউইয়র্কে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তারাও আজ অসহায়। গত পাঁচ মাস ধরে বিশ্ব এক অস্তিরতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। চারিদিকে বাতাসে লাশের গন্ধ্। ইতিমধ্যে সোয়া লক্ষাধিক প্রাণহানী ঘটেছে। দ্রুত গতিতে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্ত প্রায় আটারো লক্ষাধিক।গতকাল পযর্ন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্য ৩৯ জন। আক্রান্ত ৮০৩জন। দেশেও এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা ধারনা করেছেন এ মাসের শেষের দিক থেকে আগামী মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহটা আমাদের দেশের জন্যে করোনা ভাইরাসের সংকটকাল।এই সময়টাতেই সবাইকে নিরাপদে ঘরে থাকার জন্যে অনুরোধ করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে গত সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দেশের সকলকে বাহিরে নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান স্থগিত করে ঘরে অনলাইনে, টিভিতে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উপভোগ করার আহবান জানান ।শহুরে লোকজন ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উপভোগ করলেও সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় চৌদ্দ লক্ষাধিক কৃষকের চোখে মুখে শঙ্কা।ক্ষেতে ধান পাকতে শুরু করেছে। কিছু দিনের মধ্যেই ধান কাটতে হবে। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবে সিলেট বিভাগসহ দেশের অনেক জেলায় লকডাউন চলছে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে দেশের বিভিন্ন জেলা হতে সুনামগঞ্জে ধান কাটার লোকজন আসেন। এটি আমাদের সুনামগঞ্জ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। আমারা স্থানীয় ভাষায় তাদেরকে বেপারী বা ভাগালু বলি। ওদের সাথে বৈশাখ মাসে এক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। আবহমানকাল থেকে এই সংস্কৃতি চালু রয়েছে।এবছর বাহিরের জেলা হতে লোক আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।জেলায় ধান কাটার মেশিনও পর্যাপ্ত পরিমানে না থাকায় কৃষকের মুখে এ শঙ্কাটা দেখা দিয়েছে।অনেক কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা যায় জেলায় খেটে খাওয়া মানুষেরা দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে নগদ টাকায় ধান কাটতে চায়। আর জমির মালিকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় এক বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে।আবার দ্রুত পাকা ধান না কাটলে আরো সমস্যা দেখা দিবে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার কৃষকদের জরুরী নোটিশ জারি করা হয়েছে দ্রুত ধান কাটার জন্যে। আগামী সপ্তাহে আগাম বন্যার হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ বছর পহেলা বৈশাখ মনে আনন্দের চেয়ে বিষাদের মাত্রাই বেশি।সুনামগঞ্জের একাধিক ছোট বড় হাওরে যে পরিমান ধান উৎপাদন হয় সেটা দেশের কৃষিজাত পন্যে বিরাট ভুমিকা রাখে। আমার জন্ম ও শৈশব কৈশোরে বেড়ে উঠা জেলার তিনটি উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জের অঞ্চল পরিবেষ্টিত বিশাল শনির হাওরপারের একটি নিভৃত মশালঘাট গ্রামে। তাই বৈশাখ মাস আসলেই ছেলেবেলার বৈশাখের স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে। সেই কাটফাটা রোদে গরু দিয়ে ধান মাড়াই, ধান কাটা, ধান শুকানো, মন কাড়া নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ, বৈশাখের প্রচন্ড গরম থেকে বাঁচতে বট গাছের নিচে ছায়ায় বসে গা জুড়ানো। এ সবই এই শুধু স্মৃতিতেই আছে। প্রযুক্তি গ্রামীণ জীবনের অনেক ঐতিহ্য গ্রাস করে ফেলেছে।প্রযুক্তি অনেক কিছু গ্রাস করলেও মনের ক্যানভাস থেকে স্মৃতিগুলো মুছে যায় নি।করোনা ভাইরাসের প্রাদৃর্ভাবে গত ১৭ মার্চ হতে গৃহবন্ধী আছি। বেশির ভাগ সময় পরিবারে, পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগযোগ রাখতে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে ব্যয় হচ্ছে। লকডাউনে স্বপ্ন দেখতে তো বারণ নেই । স্বপ্ন দেখছি আগামীতে পহেলা বৈশাখ আবারো জাকজমকের সহিত দেশে পালন করব। সব কিছু আবার স্বাভাবিক হবে। পৃথিবী আবারও তার গতিতে চলবে। সময়ের প্রয়োজনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা বাদ যাবে। আবার হাসি মুখে আমার একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরব। হাতে হাত মেলাব।আমরা সেই দৃশ্যটাই চাই। আজ পহেলা বৈশাখে মহাল আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনাই করছি বিশ্বের আটশ কোটি মানুষের পক্ষে । সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা।
লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ , সরকারি দিগেন্দ্র বর্মন কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ।